এ এক স্বপ্নের দুনিয়া ‘মেটাভার্স’ । What is metaverse?

কিছুদিন আগে মার্ক জাকারবার্গ পৃথিবীতে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন, যা একুশ শতকের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিশেষ করে ইন্টারনেটের একটা মাইলফলক। জুকারবার্গের ভাষায়, “Metaverse is the Successor of Internet”। অনেকেই শুধু এটা জেনে ক্ষান্ত হয়েছেন, ফেইসবুক ফেইসবুকই থাকছে শুধু ‘Meta’ নামে একটা নতুন কোম্পানির আবির্ভাব হয়েছে। আজ এই পোস্ট ঠিক জানবো “What is metaverse?”

আগে ফেইসবুক (Facebook) ছিলো ফাদার কোম্পানি আর এখন Meta হবে ফাদার কোম্পানি। যার অধিনে থাকবে WhatsApp, Facebook, Instagram এর মতো অ্যাপস।

এটা কোনো বিশেষ ঘটনা না, ঘটনা হচ্ছে এই Meta কোম্পানি তৈরি করতে যাচ্ছে মেটাভার্স (Metaverse) নামে এক নতুন ভার্চুয়াল দুনিয়া। আমাদের ইউনিভার্স এর একটা প্যারালাল কপি হবে মেটাভার্স। এই মেটাভার্স তৈরিতে সহযোগী হিসেবে থাকছে বিশ্বের সব বড়বড় টেক কোম্পানি। সবাই মিলে নির্মান করতে যাচ্ছে এক ভার্চুয়াল দুনিয়া। যার নেতৃত্বে থাকছে মেটা (Meta)।

what is metaverse?

মেটাভার্স কী? What is metaverse?

সাধারণ মানুষের মেটাভার্স প্রযুক্তিকে আপাতত ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা ভিআর-এর কোন সংস্করণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে মেটাভার্স তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু হতে চলেছে। মেটাভার্স ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ হতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রযুক্তিবিদদের মতে বর্তমানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সঙ্গে মেটাভার্সের তুলনা আজকের দিনের স্মার্ট-ফোনের সঙ্গে আশির দশকের মোবাইল ফোনের তুলনা করার মতো বলা যায়। এক্ষেত্রে কম্পিউটারের সামনে বসে না থেকে একটি ভিআর হেডসেট লাগিয়েই যে কোনও ওয়েবসাইটে যাওয়া যাবে।

মেটাভার্সে আমরা সব ধরনের ডিজিটাল পরিবেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে একটি ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করতে পারব। বর্তমানে ভিআর (VR) বেশিরভাগই বিভিন্ন খেলার জন্য ব্যবহৃত হয়, মেটাভার্সের ব্যবহার হবে সকল বিষয়ে। যেমন এই ভার্চুয়াল জগৎটি কোনও কাজ, খেলা, কনসার্ট, সিনেমা কিংবা নিছক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতেও অনায়াসে ব্যবহার করা যেতে পারে।

অনেকেই মনে করেন মেটাভার্স প্রযুক্তিতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একটি ৩ডি অবতার বা চরিত্র থাকবে অর্থাৎ এটিই ব্যবহারকারীর প্রতিনিধিত্ব করবে। যা চারিদিকে ঘুরে বেড়ানো থেকে শুরু করে অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে পারবে। তবে এখনও পর্যন্ত মেটাভার্স শুধু মাত্র চিন্তাভাবনার স্তরেই রয়েছে, কর্তৃপক্ষ এখনও এই বিষয়ে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসেনি।

মেটাভার্স -এ আর কে আগ্রহী?

ফোর্টনাইটের (Fortnite) নির্মাণকারী এপিক গেমসের (Epic Games) প্রধান মিস্টার সুইনি (Mr Sweeney) মেটাভার্স নিয়ে তাঁর তীব্র উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। অন্য দিকে, অনলাইন মাল্টিপ্লেয়ার গেমগুলি কয়েক দশক আগের ইন্টার‍্যাকটিভ ওয়ার্ল্ড শেয়ার করেছে। তবে সেগুলি মেটাভার্স না হলেও এবিষয়ে বেশ ধারণা রয়েছে তাদের।

সম্প্রতি ফোর্টনাইট তাদের নিজস্ব ডিজিটাল জগতে তাদের প্রোডাক্ট বাড়িয়েছে, কনসার্ট, ব্র্যান্ড ইভেন্ট এবং আরও অনেক কিছু সঞ্চালনা করেছে। তাই মিস্টার সুইনির মেটাভার্সের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকেও ইতিবাচক বলেই মনে করা হচ্ছে। আবার বেশ কিছু অন্যান্য গেমের মেটাভার্সের মতো ধারণা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রোবলোক্স (Roblox) হল হাজার হাজার ব্যক্তিগত গেমের একটি প্ল্যাটফর্ম।

ইতিমধ্যে, ইউনিটি (Unity) নামের একটি ৩ডি ডেভেলপমেন্টের প্ল্যাটফর্ম বাস্তব জীবনের ডিজিটাল কপি ডিজিটাল টুইনস-এ বিনিয়োগ করছে এবং গ্রাফিক্স কোম্পানি এনভিডিয়া (Nvidia) ৩ডি ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে সংযোগ রাখতে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে তার অমনিভার্স তৈরি করছে।

কি করতে পারবেন এই মেটাভার্স এর দুনিয়ায়।

মেটাভার্স এ আপনি নিজেই নিজের একটা 3D দুনিয়া তৈরি করতে পারবেন। সেখানে আপনার একটা ‘ভার্চুয়াল কপি’ বা ‘এনিমেটেড কপি’ (Avatar) বসবাস করবে। আপনি চাইলেই সেখানে আপনার বন্ধু বা আত্মীয়দের আমন্ত্রণ জানাতে পারবেন। আপনার প্রোফাইল পিকচারের মতোই আপনার ‘3D Avatar’ সেখানে আপনার প্রতিনিধিত্ব করবে।

মজার বিষয় হচ্ছে সেখানে আপনি আপনার একাধিক ‘ভার্চুয়াল কপি’ তৈরি করতে পারবেন। যেমন গেইম খেলার জন্য একটা, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ভ্রমণের জন্য একটা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য একটা।

স্ক্যান করার নুতন মোবাইল আপা সেলফ স্ক্যান -পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একটি উদ্যোগ। 

শুধু তাই না, সেই দুনিয়ায় আপনি পছন্দমতো যেকোনো পোশাক পরতে পারবেন,কাপড় ও আসবাবপত্র কিনতে পারবেন, আপনার ভার্চুয়াল ঘর আপনার ইচ্ছেমতো সাজাতে পারবেন। অনেকে সেখানে বিভিন্ন 3D অবজেক্ট তৈরি করে বিক্রি করবে, আর আপনি কিনবেন। অবশ্য আপনিও সে দুনিয়ার বিক্রেতা হতে পারবেন, যদি আপনি 3D অবজেক্ট তৈরি করতে পারেন।

মেটাভার্সে যখন আপনি ভারত থেকে জার্মানিতে কোনো ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন, আর তখন যদি টিচার এসে আপনার কানটা মলে দেন, তাহলে আপনি সে ব্যথাও অনুভব করবেন। আপনি দুরবর্তী কারো সাথে যোগাযোগ করার জন্য, তাঁর সাথে চ্যাট করা, ছবি দেখা, কথা শোনার পাশাপাশি তাকে (ভার্চুয়াল কপি) ধরতে পারবেন এবং তার সাথে পাশাপাশি বসে কথা বলার ফিল পাবেন।

আপনার আই কন্টাক্ট, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন, বডি মুভমেন্ট সব হবে বাস্তব জগতের মতো, হুবহু। এজন্য আপনাকে একটা AR Glass পরতে হবে, যা দেখতে আমাদের সাধারণ চশমার মতোই। যেখানে একটা ক্যামেরা লাগানো থাকবে, আর কাজ করবে আপনার চোখ ও হাতের মুভমেন্টকে অনুসরণ করে। আপনার আসেপাশের পরিবেশ ভালো না লাগলে, আপনি হাঁটতে হাঁটতে বা ঘরে বসেই চলে যেতে পারবেন মেটাভার্সে।

মেটাভার্সে ঘরে বসেই আপনি ঘুরে আসতে পারবেন আমেরিকায়, চড়তে পারবেন আইফেল টাওয়ারের চূড়ায় । কিংবা ধরে দেখবেন মিশরের হাজার বছরের পুরনো পিরামিড। আপনি চাইলে সেখানে বসেই সেই পিরামিড নির্মাণের ইতিহাসও দেখতে পারবেন, স্বচক্ষে। দেখবেন প্রাচীন কাপড় পরা কোনো মিশরীয় দাস টেনে নিচ্ছে এক বিরাট পাথর, মরুভূমির বালুর উপর এই টানার শব্দ, চিহ্ন এবং সেই মিশরীয় দাসের দীর্ঘশ্বাস আপনি শুনতে পারবেন, ধরে দেখতে পারবেন সেই পাথরটিও । মহাকাশ সম্পর্কে জানতে চাইলে, মহাকাশেও একটা ভ্রমণ করে আসতে পারবেন।

আপনি চাইলেই মেটাভার্সে একটা ভারত তৈরি করতে পারবেন যেখানে ভারতের নদীনালা, খালবিল, পাহাড়, ঝর্ণা, সব থাকবে। অন্যদেরকে সে দেশে হয়তো আপনি নিমন্ত্রণ দেবেন।সেখানে ভিসা, পাসপোর্ট ও ফি’র ব্যবস্থা রাখতে পারবেন। আবার কাউকে একসেস না দিয়ে, একাই থাকতে পারবেন সে দেশে। সব মিলিয়ে আপনি নিজেই তৈরি করতে পারেন আপনার স্বপ্নের দুনিয়া। বন্ধুর সাথে বসে গল্প করতে চাইলে তাকে নক দিয়ে শুধু বলবেন, ‘এই আমার ঘরে আয়, জরুরি আলাপ আছে’। চাইলে আপনার ভার্চুয়াল ঘরে বসে, ভার্চুয়াল বোর্ডে আপনি দাবা বা টেবিল টেনিস খেলবেন, ভার্চুয়াল টিভি দেখবেন, গান শুনবেন। মিটিং, আড্ডা, ক্লাস, খাওয়াদাওয়া সব হবে মেটাভার্সে।

মেটাভার্সে আপনি ডাক্তারও দেখাতে পারবেন। সেখানে শিশুরা যাতে বিপথগামী না-হয় সে জন্য প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সিস্টেম থাকবে। সবমিলিয়ে ইন্টারনেট যে ভাবে আমাদের গ্রাস করতে যাচ্ছে, তখন আপনি কতক্ষণ অনলাইনে ছিলেন সেটা হিসেব না করে, কতক্ষণ ছিলেন না সেটা হিসাব করবেন।

মেটাভার্সের কাজ আর কত বাকি?

বিগত বছরগুলিতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হল বেশ কিছু হেডসেট, যার সৌজন্যে ভার্চুয়াল পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ানোর সময় সব কিছু থ্রিডি বলে মনে হবে। এর জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত, যেমন ২০২০ সালেই অকুলাস কোয়েস্ট ২ ভিআর (Oculus Quest 2 VR) গেমিং হেডসেটটি সেই বছরের ক্রিসমাসে জনপ্রিয় উপহারের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল।

আবার এনএফটিএসে (NFTs) সম্প্রতি অনেকের বিপুল আগ্রহ থাকায় তা ডিজিটাল পণ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার সঙ্গে মালিকানা তদারকির একটি পথ বাতলে দিচ্ছে। এটি একটি ভার্চুয়াল অর্থনীতি কী ভাবে কাজ করবে তা দেখাতে সক্ষম হয়েছে।

আবার, এটাও অস্বীকার করা যায় না যে উন্নত প্রযুক্তির ডিজিটালের কাজের জন্য প্রয়োজন আরও ভালো, সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ৫জি-র মতো মোবাইল সংযোগ ব্যবস্থা যা মেটাভার্সের পক্ষে লাভজনক বলে স্বীকৃত হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদদের মতে, ইন্টারনেটের গতি আরও দ্রুত হলে, বিশেষ করে ফাইভ-জি বাজারে আসার পরেই, মেটাভার্স সম্পর্কিত অনেক সমস্যার সমাধান ঘটবে।

যাই হোক, আপাতত মেটাভার্সের সব কিছুই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। যদি মেটাভার্স মানুষের হাতের নাগালে আসে, তাহলে তা প্রযুক্তির দুনিয়ায় পরবর্তী দশকের কিংবা সম্ভবত আরও দীর্ঘ সংগ্রামের মাইলফলক হয়ে থাকবে বলা যায়।

Leave a Comment